বাংলাদেশের নামকরণ
“বাংলাদেশ” নামটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বীকৃতি লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে নতুন দেশটির নাম হয় “বাংলাদেশ”। যা বাঙালি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নামের মাধ্যমে বাঙালিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় “বাংলাদেশ” শব্দটি পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে দেশটির নাম “বাংলাদেশ” করার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন পায়। এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশটির নামকরণ হয় “বাংলাদেশ”।
বাংলাদেশ শব্দটির জনক
“বাংলাদেশ” শব্দটির জনক বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ১৯০৫ সালে “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি” শিরোনামে একটি গান লিখেন। তার লেখায় প্রথম “বাংলাদেশ” নামটির ব্যবহার পাওয়া যায়। তবে, তিনি প্রথম “বাংলাদেশ” শব্দটি ব্যবহার করলেও পূর্ব পাকিস্থানের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নামটির একটি গর্বিত জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। এই নামের উৎপত্তি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের গভীরতা বহন করে।
“বাংলা” শব্দের উৎপত্তি
“বাংলা” শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত আছে। প্রধানত দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস বিবেচনা করা হয়:
- বঙ্গ জনপদ থেকে:
“বাংলা” শব্দটি “বঙ্গ” থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীনকালে গঙ্গার পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে “বঙ্গ” বলা হতো। এই অঞ্চলটি আজকের বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের অংশবিশেষ হিসেবে পরিচিত। “বঙ্গ” নামটি একসময় “বাংলা” রূপে বিবর্তিত হয়। - দ্রাবিড় বা প্রাকৃত ভাষা থেকে:
কিছু ভাষাবিদ মনে করেন যে “বাংলা” শব্দটির উৎপত্তি দ্রাবিড় ভাষা থেকে, যেখানে “বঙ্গ” শব্দের অর্থ ‘পাহাড়ি’ বা ‘উচ্চভূমি’। অন্যদিকে, কিছু প্রাকৃত ভাষায় “বঙ্গ” শব্দের অর্থ হতে পারে ‘জলাশয়’ বা ‘জলপূর্ণ এলাকা’, যা এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
এই দুটি তত্ত্বই “বাংলা” শব্দটির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে সহায়ক বলে ধরা হয়।
পটভূমি
বাংলাদেশ নামকরণের পটভূমি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই নামটি বাঙালি জাতির পরিচয় এবং তাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের নামকরণের পটভূমি কয়েকটি ধাপে বিবেচনা করা যায়:
১. বঙ্গ এবং বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস:
“বঙ্গ” একটি প্রাচীন নাম, যা বহু শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত। বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চলে সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক পরিচয় বিদ্যমান ছিল। বাংলা শব্দটি ধীরে ধীরে বঙ্গ থেকে বিবর্তিত হয় এবং এই অঞ্চল “বাংলা” নামে পরিচিতি পায়।
২. মুসলিম শাসনামলে বঙ্গ:
১৩শ শতাব্দীর দিকে মুসলিম শাসকরা বাংলায় প্রবেশ করে এবং সুলতানি আমলে বাংলা সুলতানate গড়ে ওঠে। এই সময়ে “বাংলা” নামে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা গড়ে ওঠে। যা আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে।
৩. ব্রিটিশ শাসন ও বঙ্গভঙ্গ:
ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করে। একটি পূর্ব বাংলা এবং অপরটি পশ্চিম বাংলা। ১৯১১ সালে এই বিভাজন প্রত্যাহার করা হয়। তবে বঙ্গভঙ্গ বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার বীজ বপন করে।
৪. পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীনতা আন্দোলন:
ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের সময়, বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অংশ হয়। কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সাথে অসন্তুষ্ট ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত, বাঙালিরা তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
৫. মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা:
বাংলাদেশের নামকরণে স্বাধীনতার যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করে।
৬. বাংলাদেশ নামের গ্রহণ:
বাংলাদেশের নামটি মূলত “বাংলা” থেকে এসেছে, যা বাঙালি জাতির পরিচয়কে ধারণ করে। “দেশ” শব্দটি যুক্ত করে এটিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। “বাংলাদেশ” অর্থাৎ “বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ” বা “বাঙালির দেশ” নামে এই বাংলাদেশের নামকরণ করা হয়। এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তাদের দীর্ঘকালীন সংগ্রামের প্রতীক।
বাংলাদেশ নামটি জাতীয় পরিচয়, ঐতিহ্য, এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সাথে জড়িত, যা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালিদের গর্বের প্রতীক।
আরো পড়ুনঃ
- ভারতে ইলিশ রপ্তানী বন্ধ, ৫০০ টাকা কেজিতে খেতে চায় বাংলাদেশের মানুষ
- বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মূল কবিতাটি কি? কবিতটি মোট কত লাইনের?
Follow us: Facebook, Twitter, Instagram, Youtube